শুক্রবার, ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

লকডাউন নিয়ে জীবনের চরম দুইটি অভিজ্ঞতা : বীর মুক্তিযোদ্ধা আ.স.ম. আব্দুর রহিম পাকন

স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় ঐক্যের রূপকার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বাঙালি জাতির স্বতন্ত্র জাতি-রাষ্ট্র ও আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার সুমহান ঐতিহ্যের প্রতীক। আওয়ামী লীগ এ দেশের বৃহত্তম প্রাচীন রাজনৈতিক দল।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালো রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আধুনিক অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বাঙালি জাতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। এরই প্রেক্ষাপটে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। শুরু হয় রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে গিয়ে বন্দি করে রাখা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতেই তাকে রাষ্ট্রপতি করে গঠিত বাংলাদেশের সরকারের অধীনে পরিচালিত দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। এই বিজয় অর্জনে মধ্য দিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের।

লকডাউনের প্রথম অভিজ্ঞতাঃ

১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি বাঙালির প্রাণপ্রিয় নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখলেন এবং দেশবাসীকে বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করার লক্ষ্যে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার আহবান জানালেন। বাঙালি তাতে সাড়া দিলেন কিন্তু দেশের মধ্যে লুকিয়ে থাকা স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি ও কিছু রাজনৈতিক উচ্চবিলাসীরা তাঁর গঠনমূলক কর্মসূচিকে বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্থ করতে শুরু করে এবং বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে একটি রাজনৈতিক দলের জন্ম দেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সমস্ত ষড়যন্ত্রকে উপেক্ষা করে বাংলার জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর দেওয়া প্রতিশ্রুতি মোতাবেক দেশ পুণর্গঠনে আন্তরিকভাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ১৯৭৪ সালে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসাবে বাঙালী জাতির জীবনে নেমে আসে ভয়াবহ বন্যা। আর এই প্রাকৃতিক দুর্যোগকে পুঁজি করে আন্তর্জাতিক ও দেশের মধ্যে লুকিয়ে থাকা স্বাধীনতার বিরোধী, অতি উৎসাহী বিপ্লবীরা একত্রিত হয়ে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে দেশের মধ্যে দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি করেন এবং সরকার পতনের বিভিন্ন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। সেই ষড়যন্ত্রের নীল নকশা অনুযায়ী স্বাধীনতা বিরোধী চক্র ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট রাতের অন্ধকারে জাতির পিতাসহ তাঁর পরিবারের সকল সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করেন।

পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালা’র অশেষ রহমতে জাতির পিতার দুই সুযোগ্য কন্যা দেশে না থাকার কারণে প্রাণে বেঁচে যান। সেদিন তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি। তারা সামরিক শাসনের নামে আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিকলীগসহ বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনকে নিধন করতে মরিয়া হয়ে উঠে। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিল গুম, হত্যা, গৃহবন্দী এবং অনেককেই জীবন বাঁচাতে ছাড়তে হয়েছিল তাঁদের প্রিয় মাতৃভূমি। এই নির্যাতন ও অত্যাচার থেকে আমিও পরিত্রাণ পায়নি।

বিভিন্ন সূত্রে জানতে পারলাম সাবেক মন্ত্রী বর্তমান আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নাসিম ভাই সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ভারতের কলকাতায় গিয়ে এই হত্যার প্রতিবাদ করার লক্ষ্যে সংঘবদ্ধ হচ্ছেন। আমি তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে কলকাতায় চলে যাই এবং নাসিম ভাই সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হই। সেখানে এক বেলা খেয়ে না খেয়ে ৬ মাস থাকার পর নেতৃবৃন্দের পরামর্শক্রমে আবার দেশের মধ্যে ফিরে আসি এবং সামরিক বাহিনী কর্তৃক গ্রেফতার এড়ানোর জন্য আত্মগোপনে যাই। দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকার পর ১৯৭৬ সালের ১১ ই আগস্ট সকাল দশটার দিকে তৎকালীন সামরিক সরকারের গোয়েন্দা বাহিনী কর্তৃক ঢাকার নবাবপুর রোডের একটি অফিস থেকে আমি গ্রেফতার হই।

গ্রেফতারের পর আমাকে গোয়েন্দা বাহিনীর লোকেরা তৎকালীন গুলিস্তান বাসস্ট্যান্ডে তাদের রাখা গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানের কাছে আসার পর আমাকে মাস্ক না পড়িয়ে কালো কাপড়ের পট্টি দিয়ে চোখ বেঁধে ঢাকা সেনানিবাসে তাদের নির্যাতন বা ইন্টারোগেশন সেলে নিয়ে যায়। সেই নির্জন সেলে আমাকে আড়াইটি মাস একাকীত্ব জীবনযাপন ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়। নির্যাতনের অংশ হিসাবে ছিল কালো পট্টিতে চোখে বেঁধে ঝুলন্ত অবস্থায় আঘাত এমনকি পুরুষ লিঙ্গের সঙ্গে ইট বেধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। সেখানে আমি আড়াই মাস দুনিয়ার আলো থেকে বঞ্চিত ছিলাম। তাপরপর চোখে কালো পট্টি বেঁধে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে আসা হয়। এখানেই পরিসমাপ্তি ঘটে আমার প্রথম লকডাউনের অভিজ্ঞতা। কেন্দ্রীয় কারাগারে যাবার পর সেখানে সাবেক মন্ত্রী মরহুম শেখ আব্দুল আজিজ, মরহুম মোমিন তালুকদার, আওয়ামী লীগ নেতা আমু ভাই, মরহুম গাজী গোলাম মোস্তফা, পল্টু ভাই, মায়াভাই, পাহাড়ী ভাই, এসপি মাহবুব ভাইসহ শতাধিক আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ এবং শ্রমিক লীগের নেতৃবৃন্দের সংস্পর্শে এসে আমি নতুন জীবন ফিরে পেলাম। এইভাবে কেন্দ্রীয় কারাগারে আমার প্রথম লকডাউন আড়াই বছর কেটে গেল।

লকডাউনের দ্বিতীয় অভিজ্ঞতাঃ

১৯৭৯ সালে কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে আমি আবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে আইন বিভাগে ভর্তি হই। কিন্তু পারিবারের অভাব অনটনের কারণে আমার বাবা আমাকে জানিয়ে দেন তাঁর পক্ষে পড়াশোনার খরচ চালানো সম্ভব নয়। সেই কারণে কোন কুল কিনারা করতে না পেরে ১৯৮১ সালে বাবা-মার অনুরোধে তৎকালীন জার্মানে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত বিদেশের মাটিতে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পতাকা উত্তোলনকারী আমার চাচা মৃত এম হোসেন আলীর সহায়তায় ভিয়েনায় গমন করি। ভিয়েনায় অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে পরম করুণাময় আল্লাহ পাকের রহমতে ১৯৮৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর ১২ দিনের চুক্তির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থায় চুক্তিভিত্তিতে চাকরি পাই। আমার কর্মদক্ষতা ও সততার কারণে সংস্থা আমার চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি করে স্থায়ীভাবে নিয়োগদান করেন। ৩০বছর সুনামের সাথে চাকরি করার পর ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে চাকুরী থেকে অবসর নিয়ে দেশমাতৃকার টানে আবার দেশে ফিরে আসি।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ’কে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে নিঃস্বার্থভাবে নিরলসভাবে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করি। কিন্তু ২০১৮ সালে আমি দেশে থাকা অবস্থায় আমার সহধর্মিনী দুইবার স্ট্রোক করেন। ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন শেষ হওয়ার পর ২০১৯ প্রথমদিকে আমি ভিয়েনা এসে তার চিকিৎসা ও ডাক্তারের পরামর্শ কাজ শেষ করে তাকে সঙ্গে নিয়ে আবার দেশে ফিরে আসি। কিন্তু সহধর্মিনীর রুটিন চেকআপের অংশ হিসাবে ২০২০ সালের প্রথমদিকে তার চিকিৎসা ও ডাক্তারের পরামর্শের জন্য ভিয়েনাতে আসতে বাধ্য হই। ডাক্তারের পরামর্শ ও চিকিৎসার কার্যক্রম শেষ করে যখন আবার মাতৃভূমিতে ফেরৎ আসার উদ্যোগ নিয়েছি ঠিক সেই মুহুর্তে সারা বিশ্ব করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। এ মরণ ব্যাধী থেকে বাংলাদেশও রেহাই পায়নি। মহামারী করোনাভাইরাস যখন অস্ট্রিয়াতে বিস্তার লাভ করতে শুরু করে । এদেশের সরকার ১৬ ই মার্চ থেকে সারাদেশে লকডাউন ঘোষণা দেন।আর তখনই অর্জন হয় দ্বিতীয় লকডাউনের অভিজ্ঞতা । এবং অস্ট্রিয়ার জনগণ সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায়। সরকার কর্তৃক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য যে সমস্ত নির্দেশনা দেন তা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলার কারণে ধীরে ধীরে শিথিল করার মাধ্যমে বর্তমানে লকডাউন তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের জনগণকে এই মহামারী থেকে রক্ষা করবার জন্য স্বাস্থ্যবিধি অনুসারে বিভিন্ন ঘোষণা দিলেও আমরা তা পুরাপুরি কেন মানছি না সে বিষয়ে আমার কাছে প্রশ্ন থেকে যায়। এজন্য বিদেশে থাকা অবস্থায়ও আমার মনটা দুঃখ ও বেদনায় ব্যথিত হয়। করোনা ভাইরাসকে পুঁজি করে দেশের মধ্যে একটি শ্রেণী বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সকল উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য বিভিন্ন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। ঠিক যেমনভাবে স্বাধীনতা পরবর্তী জাতির পিতার সকল উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করেছিল। আজ তেমনি একটি গোষ্ঠী সরকারের মধ্যে থেকে ও বাইরে থেকে আবারও সোচ্চার হয়েছে। তারা এই মুহূর্তে যুদ্ধাপরাধের দায় দন্ডিত আসামিদের মুক্তির দাবি সহ বিভিন্ন শিল্প-কারখানা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকদেরকে উস্কানি দিয়ে সরকারের স্বাস্থ্যনীতিকে উপেক্ষা করে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছেন। সেই সঙ্গে দলের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অনেক চেয়ারম্যান মেম্বরদেরকে কাজে লাগিয়ে সরকারের দেওয়া সাধারণ মানুষের সাহায্য জনগণের দ্বারপ্রান্তে না পৌঁছায় সেই কাজে লিপ্ত হওয়ায় সহায়তা করছে। যেমনটি ১৯৭৪ সালে জাতীয় দুর্যোগ বন্যাকে কাজে লাগিয়ে বঙ্গবন্ধুকে জনগণের হৃদয় থেকে কেড়ে নিয়েছিল।

মানবতার প্রতীক হে ! প্রিয় নেত্রী আপনি দেশের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের একমাত্র কান্ডারী। কেননা আপনি মানুষের কল্যাণে জাতির পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে পৌঁছে দিয়েছেন। আপনি করোনা সংক্রামন থেকে দেশকে বাঁচাতে কঠোর হউন। ডাক্তার, সেনাবাহিনী, পুলিশ, প্রশাসনসহ বাংলার জনগণ আপনার পাশে আছে এবং থাকবে। আমরা জাতির পিতাকে হারিয়েছি সে কষ্ট আজও মন থেকে ভুলতে পারি না। তাই নতুন করে আর আপনাকে হারাতে চাইনা।

এখানে মহামান্য রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ এর সদ্য একটি উক্তি উল্লেখ করছিঃ “ শেখ হাসিনা শত্রুর আগুনের ছাই থেকে উঠে আসা এক মানুষ”। আসুন আমরা সবাই জননেত্রী শেখ হাসিনার পাশে থেকে তাঁর উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখতে সকল ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াই।……জয় বাংলা । জয় বঙ্গবন্ধু ।

লেখকঃ বীর মুক্তিযোদ্ধা আ.স.ম আব্দুর রহিম পাকন। উপদেষ্টা-বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ,পাবনা জেলা শাখা। কার্যনির্বাহী সদস্য, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম- মুক্তিযুদ্ধ ‘৭১, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ।

এই বিভাগের আরো খবর